top of page

কিছুক্ষণ আরো না হয়...

Writer's picture: SambandhSambandh

Updated: Oct 12, 2024

অ রি জি ৎ গা ঙ্গু লি

ইংল্যান্ড


এমন মিষ্টি একটা আবদার ফেলতে পারলেন না মলয়বাবু। কেমন করেই বা উপেক্ষা করতেন! নাতনির চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় বাকি সব কাজ থাকুক পড়ে, আগে ওর সঙ্গে মুল্যবান কিছুটা সময়তো কাটানো যাক। লম্বা অপেক্ষার পর ওকে কাছে পাওয়া যায়৷ তাই মলয়বাবু এর গুরুত্ব বোঝেন।


ওঁর সহধর্মিণী রমা মুখে কিছু বলেন না তেমন। কিন্তু তিনি ভালোভাবেই জানেন যে হাজার কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকলেও শেষের এই দু একদিন ওদের দুজনের মনের ভেতরেই কেমন উথাল-পাথাল চলে। মলয়বাবু বরাবর স্পষ্টবক্তা৷ যা মনে আসে, সব আপনজনদের কাছে বলে পেট খালি করে বলে দেন। এতে মনের ভার লাঘব হয়। কিন্তু একটিমাত্র ব্যাপারে তিনি মুখ বন্ধ রাখেন। কাউকে জানতে দেন না কী চলে ওঁর মাথার মধ্যে। সবই ওই ছোট্ট ফুটফুটে নাতনিটার মুখ চেয়ে।


সবে দপুুরে খাওয়াদাওয়ার পালা সাঙ্গ হয়েছে । বিরক্তিকর কোমরের ব্যথা আর বৌমার হাজার বারণ সত্ত্বেও সকাল থেকে লাইন দিয়ে বেশ টাটকা ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছিলেন মলয়বাবু। রান্নাঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে আসা এক ফালি রোদে মাছের গা চিকচিক করতে দেখে ছোট্টো দিয়াশার সে কী আনন্দ! "দাদাই দাদাই, এই ফিশ আমায় জ্যান্ত ধরে দাও না, ওখানে নিয়ে গিয়ে পুষব।" ওর বাঙলায় টান আছে, বিদেশীদের মতো উচ্চারণ করে। কিন্তু সেটা শুনতে আরো বেশি ভালো লাগে । বাঙলা যতদিন বলতে পারে, ততদিন মঙ্গল। এরপর বড় হয়ে গেলে ফরফর করে ইংরিজি বেরোবে। তবে মলয়বাবু সে নিয়ে ভাবেন না, কারণ তখন সেই বিদেশী ভাষা শোনার জন্য তিনি আর ইহলোকে থাকবেন বলে আশা করেন না৷


একে তো জ্যান্ত খোকা ইলিশ, তায় তাকে নিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা। এ যে অসম্ভব এক ব্যাপার, তা এখন কেমন করে বোঝান অবুঝ নাতনিকে! বৌমা মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করায় মেয়েকে, "এই মাছ পোষে না বোকা মেয়ে, এর স্বাদ নিতে শেখ। ওখানে তো ফ্রোজেন খেয়ে কিছুই টের পাস না।" মলয়বাবুর ছেলে টেবিলের ওপাশ থেকে বলে, "বুঝলে বাবা, ওই দেশে ফ্রোজেন মাছের আসল বয়স বোঝা শক্ত। বরফে ওরা মাছ মাংস বছরের পর বছর রেখে দিতে পারে। পদ্মার যে ফ্রোজেন ইলিশ আমরা পাই, তার অকালমৃত্যু হয়ত বঙ্গভঙ্গের সময় হয়েছিল।"

ছোট দিয়াশার কাছে এইসব শব্দ অচেনা। "বোংগোবোংগো কী দাদাই?" মলয়বাবু প্রসঙ্গ বদলে দেন। আজকের দিনে আবার ভাঙাভাঙির কথা কেন।


রমা দেবীর শরীরটা আজকাল আর দেয় না। বয়স অনুযায়ী ভেঙে যাওয়া চেহারা খাপ খায় না৷ কিছুনা কিছু একটা রোগ লেগেই থাকে হামেশা। এই তো ছেলে বৌমারা আসার আগেই দু তিন সপ্তাহ ভুগলেন ভাইরাল জ্বরে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে শরীর শুকিয়ে গেল নিমেষে। কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে কোনোরকমে চাঙ্গা করলেন নিজেকে। তাও দুর্বলতা এখনো কাটেনি। রান্নার হ্যাপা সামলানোর পর দুপুুরটা একটু গড়িয়ে না নিলে উনি পারেন না। আজ ক্লান্ত চোখেও তিনি জেগে ৷ নাতনি দিয়াশার আবদার শুনে বিছানার এক কোণ থেকে স্বামীকে বলেন, " অ বুড়ো, যাও না একবার, এত করে বলছে যখন। আজ অতটা রোদ নেই, কষ্ট হবে না৷ বৌমারা গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত, মেয়েটা শুধু শুধু বোর হচ্ছে।"


মলয়বাবুও এই সুযোগ হারাতে চান না। আলনা থেকে ফতুয়াটা নিয়ে গায়ে গলিয়ে নেন। তারপর নাতনির হাত ধরে বেরিয়ে পড়েন এই ভরদপুুরে। হংসের মাঠ। এই নাম ওঁরই দেওয়া। দিয়াশার চার বছর বয়স অবধি প্রতিদিন নিয়ম করে দাদু আর নাতনির বৈকালিক ভ্রমণের ঠিকানা ছিল ছোটবাজার সংলগ্ন এই পুকুর, আর তাকে ঘিরে থাকা সবুজ ঘাসের মাঠ। হাঁসের দল সারি বেঁধে সেই পুকুরের কিনারায় আসত দিয়াশার হাত থেকে পাঁউরুটি আর মেরি বিস্কুটের টুকরো খেতে। সন্ধে হয়ে গেলেও সে বাড়ি ফিরতে চাইত না। হাঁসের দুনিয়ায় থেকে গেলেই যেন সবচেয়ে খুশি হত।


এবারেও বেশ কয়েকবার দাদাইয়ের সঙ্গে এসেছে। কয়েক পা এগিয়ে ঢেঁকির মাঠেও গেছে। সেখানে ঢেঁকি আর দোলনা চড়ার পর কচি ডাব খেয়েছে স্ট্র ঢুকিয়ে ৷ আগামীকাল ফিরে যাওয়ার আগে দিয়াশার ইচ্ছে হয়েছিল বন্ধু হাঁসেদের একবার গুডবাই বলবে । দাদাইকে রাতে শুয়ে শুয়ে সে ওই দেশের পার্কের গল্প শোনায়। সেখানেও অনেকগুলো বিলিতি হাঁস তার বন্ধু হয়েছে। আরো কত সব পাখির নাম বলে। লোমশ একটা ডগির গল্প শোনায়। দিয়াশা পার্কে গেলেই সবাই নাকি হ্যালো বলতে আসে। তবে হংসের মাঠের এই বন্ধুদের সে ভুলতে পারেনি আজও। কিছু জিনিস হয়ত সহজে ভোলা যায় না।


" দিদিভাই, আবার কবে আসবি মা? "

মলয়বাবুর চোখের কোণে হঠাৎ আগত জলবিন্দুর দিকে দৃষ্টি পড়েনি দিয়াশার। একটা রাজহাঁসের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তেই সে বলে, "আবার মা দুগ্গা এলেই আমি চলে আসব দাদাই।" মলয়বাবু চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মোছেন, আর ধরা গলায় বলেন, "তুইই তো আমার মা দুগ্গা রে সোনা মা। বাপকে ঠিক রাজি করিয়ে আনবি কিন্তু! ও একদম আমার কথা শোনে না, ব্যাড বয়। তুই বায়না করলে ফেলতে পারবে না দেখিস।" দিয়াশা বিজ্ঞের মতো আশ্বাস দিয়ে মাথা নেড়ে আবার মেতে ওঠে খেলায়৷ মলয়বাবু চেয়ে থাকেন দূরে হাঁসেদের ধাওয়া করা বাচ্চা মেয়েটার দিকে। আর মাত্র একদিন। তারপর আবার অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু।


বাড়িতে গোছগাছের পালা এখন তুঙ্গে। শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা চলছে জোরকদমে। ঘরভর্তি ব্যাগ আর নতুন জামাকাপড় ছড়ানো। ছেলে বৌমার এখন দম ফেলার অন্ত নেই। প্রতিবার এই শেষ দিনের হুড়োহুড়ি সহ্য হয় না মলয়বাবুর। চাইলেই আগে থেকে অল্প অল্প করে গুছিয়ে রাখতে পারে । কিন্তু কে শোনে কার কথা। এক মাস ঘুরে ঘুরে সারা বছরের রসদ কিনে নিয়েছে ওরা৷ এখন সে গুলোকে ওজন অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যাগে ভরে নেওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ।


রমাও হাত লাগিয়েছেন এই মহাযজ্ঞে । তার ওপর তিনি আবার আচার আর নারকেল নাড়ু তৈরিতে ব্যস্ত। ভালো পাক ধরেনি বলে মেজাজ খিঁচিয়ে আছে তাঁর৷ রান্নাঘর থেকে গজগজ শুনতে পাচ্ছেন মলয়বাবু। বেশিরভাগ যে তাঁরই উদ্দেশে ধেয়ে আসছে, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। এ তো রোজকার ব্যাপার। ছেলে বৌমারা এলে এক মাস এই নিয়মের একটু হেরফের হয়, কিন্তু তারপর সারা বছর তো সুখ দুঃখের ভরসা এই দুজনেই। এর ওর মখু চেয়ে বেঁচে থাকা। একে অপরকে বুড়ো বয়সের নরম গরম কথা শুনিয়ে, বা ছেলে বৌমার কাছে নালিশ জানিয়ে আবার সেই লম্বা অপেক্ষায় নিজেদের নিয়োজিত করা। এতে একটা প্রচ্ছন্ন মজা আছে যদিও। সবুরে মেওয়া ফলার মজা। শুধু আজকাল 'মেওয়া'-র সংজ্ঞাটা বদলে গেছে। এখন ওদের গোটা মনন জুড়ে একটাই চিন্তা বিরাজ করে। নাতনিটা যেন সুস্থ থাকে, আনন্দে থাকে। মলয়বাবু ভাবেন মা দুগ্গা যদি সারাবছর ধরে বাপের বাড়িতে এসে বসে থাকতেন, তাহলে কি পুজোর ওই পাঁচটা দিনে আলাদা রকমের মজা হত? বছরভর জমানো প্রাণশক্তি উজাড় করে দিতে বাঙালি অপেক্ষা করে পাঁচদিন ব্যাপী মাতৃপক্ষের। আর মলয়বাবু দিন গোনেন সুদূর বিলেত থেকে তাঁর নাতনির আগমনের৷ তাঁকে তো এই এক মাসেই সব প্রাণশক্তি সঞ্চয় করে নিতে হয়। নয়ত পরের লম্বা একটা বছর কাটবে কী করে? কথায় আছে আসলের থেকে সুদ বেশি মিষ্টি ৷ সেটা তিনি এখন ভালোই অনভুব করেন।


হাঁসেদের বিদায় জানিয়ে দাদাইয়ের কোলে উঠে পড়ে দিয়াশা। বাকি পথটুকু সে এইভাবেই ফিরতে চায়। আজ আর অন্য কোথাও যাওয়ার সময় নেই। মলয়বাবু খেয়াল করলেন অদ্ভুতভাবে তাঁর কোমরের ব্যথাটাও যেন আজ উধাও।


দিয়াশা জিজ্ঞেস করে, " তুমি আমাদের কান্ট্রিতে আসোনা কেন ঠাম্মিকে নিয়ে ? আমরা তাহলে ফান করতাম সবাই মিলে। বাবা তো কত রিকোয়েস্ট করে তোমাকে। তুমিও তো কোনো কথা শোনো না আমার বাবার।" নাতনির এই সরল অভিযোগ মিথ্যে নয়। ছেলে বহুবার সাধাসাধি করেছে পাসপোর্ট বানিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু নাছোড়বান্দা মলয়বাবু প্রতিবার তা নাকচ করে দিয়েছেন। এই 'কান্ট্রি', এই বাড়ি ছেড়ে যেতে তাঁর মন চায় না। বিদেশ ঘোরার বাসনা কোনোকালেই তাঁর ছিল না। স্ত্রী রমাও এতে মদত যোগান। বলেন ছেলেপুলের সংসারে না ঢোকাই ভালো। সুন্দর সম্পর্কটা শুধু শুধু খারাপ করার কোনো মানে হয় না।


দিয়াশার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না মলয়বাবু। কথা ঘোরানোর জন্য পাড়ার চায়ের দোকানের বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নাতনিকে দেখান। তারাও ফিরতি হাত নাড়ে৷ সন্ধে ঘনিয়ে আসে।


ডিনারের সময় স্বভাব মতো আর একবার চেষ্টা করে দেখলেন মলয়বাবু। "একটা মাস নেহাত ছোট নয়, তাও বড্ড কম লাগে রে। যেন ফুরুত করে কেটে যায়। সুখের সময় ধরে রাখা যায় না। দেখ না যদি পরেরবার একটু বেশি ছুটি ম্যানেজ করতে পারিস। আমার শরীর খারাপ টারাপ কিছু একটা বলে দিবি নাহয়।"


ছেলে মুখে খাবার নিয়েই জবাব দেয়, "সম্ভবই নয় বাবা। হাতে থাকা সব ছুটি খরচা করেই আসতে হয়। ফিরে গিয়ে দরকার হলেও আর ছুটি নিতে পারি না। এইজন্য বলি প্ল্যান ক'রে চলে এসো ওদিকে । ছয় মাস দুজনে মিলে থেকে যাও আরাম করে। কথা তো শোনো না, কী আর বলব।"


মলয়বাবু প্রতি বারই এই এক মাস ছুটির সময়সীমা বাড়ানোর জন্য বৃথা আবেদন জানান ছেলের কাছে। জানেন একই উত্তর শুনতে হবে। তাও চেষ্টা থামান না।


আগামীকাল এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করতে ব্যস্ত ওরা৷ চাইলেই এখন গাড়ি পাওয়া যায় না সহজে। বড়সড় গাড়ি লাগবে এতগুলো লাগেজ তোলার জন্য৷ তার ওপর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুনলেই গাড়ির মালিকরা আকাশছোঁয়া দর হেঁকে দেয়।


"কটায় যেন ফ্লাইট তোমাদের?" খাওয়ার টেবিল মুছতে মুছতে বৌমাকে জিজ্ঞেস করেন রমা।


"দুপুর একটায় তো দেখাচ্ছে মা৷ কিন্তু এই এয়ার ইন্ডিয়ার কোনো ভরসা নেই৷ দেরি হলে লাস্ট মোমেন্টে জানাবে। নাও জানাতে পারে৷ চেষ্টা করছি ইন্টারনেটে দেখার। এখনও তো বলছে রাইট টাইম, দেখা যাক৷"


ছেলে ফোন রেখে বলে, "একটা গাড়ি পেলাম ফাইনালি। তিন ঘন্টা আগে আসতে বলেছি৷ এবার মনে হচ্ছে এত কিছু নিয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারলে বাঁচি৷ এত প্ল্যানিং আর হ্যাপা পোষায় না৷ গিয়েই আবার অফিসের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অনেক কাজ জমে গেছে এতদিনে৷ এক মুহূর্তও দম ফেলার সময় পাব না কেউ। দিয়াশার স্কুলও শুরু পরেরদিন থেকে।"


মলয়বাবু দিয়াশাকে কোলে বসিয়ে ওর পিঠে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরেন৷ সে একটু ছটফট করলেও দাদাইয়ের এই খেলায় সে এখন অভ্যস্ত৷ দাদাই কান দিয়ে শোনেন ছোট্ট প্রাণের ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ। মিলিয়ে নিতে চান নিজের হৃদয়ের শব্দকে। এক সুরে মেলাতে চান, কিন্তু তা হয়ে ওঠে না৷ এই অছিলায় প্রাণ ভরে নাতনিকে কাছে ধরে রাখেন তিনি। নাতনি ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে এই খেলা আরো ঘন ঘন হয়৷ "মনে হয় এইভাবেই তোকে জড়িয়ে রেখে দী দিদিভাই। এখানেই থেকে যা না একটা বছর৷" দিয়াশার সুড়সুড়ি লাগে। সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলে, "ঠাম্মিকে রেখে যাচ্ছি তো৷ তোমরা এরকম করেই হাগ করে বসে থেকো।"


রাতে দাদু নাতনির গল্পের আসর আজ যেন শেষই হতে চাইছে না৷ লম্বা ফ্লাইটের ধকল আছে পরেরদিন৷ বৌমা দিয়াশাকে বলে গেছে ভালো করে ঘুমিয়ে নিতে। কিন্তু ঘুম যে উড়ে গেছে দুজনের। বাচ্চামানুষ ঠিক ঘুমিয়ে নেবে সুযোগ পেলেই। তবে এই মহামূল্য সময় তো ফেরত আসবে না সহজে৷ দাদাইয়ের আশকারা পেয়ে দিয়াশা তাই একনাগাড়ে ওর স্কুলের গল্প বলে যাচ্ছে৷ মলয়বাবুর মাথায় অবশ্য কিছুই ঢুকছে না৷ শুধু মিষ্টি গলাটাই কানে আসছে৷ তাই সই৷ মনে মনে ভাবছেন সকালটা কীভাবে কাটবে৷ বিদায় জানানোর পালা বড় কঠিন। বলা ভালো সবচেয়ে কঠিন একটা সময়। বয়স বেড়ে গিয়ে আরো উপলব্ধি করেন ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা। তাতে কষ্ট আরো বাড়ে৷ তাঁর ছেলে অনেক স্মার্ট, তবুও সে গাড়িতে ওঠার আগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কেঁদে নেয়৷ মলয়বাবু প্রাণ খুলে কাঁদতে পারেন না। ভেতরে পুষে রাখেন কষ্টটা। চোখের জলে আপনজনদের বিদায় জানাতে নেই৷ তাও মনকে বশে রাখা যায় না৷ রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নেন বারবার। ওঁর নিজের মেয়ে নেই, একমাত্র এই ছেলে। তাও প্রতিবার যেন নাতনি টাটা করলে নিজের মেয়েকে বিদায় জানানোর কষ্ট ভোগ করেন। এক সপ্তাহ আগে মা দুগ্গা ফিরে গেছেন। এবার এই মায়ের পালা।


সাত পাঁচ ভাবতে গিয়ে খেয়াল করলেন নাতনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। নিজেও একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করেন মলয়বাবু।


সকালে উঠে দেখেন বাইরের বারান্দায় সমস্ত লাগেজ জড়ো করা হয়েছে। হাঁটাচলার জায়গা আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। গাড়িতে এত মাল একসঙ্গে উঠবে কিনা সেই চিন্তায় বৌমা এঘর ওঘর করছে। রমা ছলছলে লাল চোখে নারকেল নাড়ুর শিশি হাতে এক কোণে দাঁড়িয়ে৷ আচার তার নির্দিষ্ট আসন পেয়ে গেছে, কিন্তু নাড়ুরা এখনো ব্রাত্য। জায়গা মনে হয় বাকি নেই আর। ছেলে উত্তেজিত হয়ে ফোনে কথা বলছে কারুর সঙ্গে। ড্রাইভার আসতে দেরী না করে আবার। মলয়বাবু নাতনির খোঁজে ছাদের দিকে পা বাড়ালেন।


চান করে নতুন জামাকাপড় পরে সে তৈরি আগে থেকেই। দাদাইকে দেখে ছুটে এগিয়ে এসে একটা হামি দেয় বড় করে। ফিরতি হামি নেওয়ার আগেই আবার ছুটে পালায় একটা পাখিকে তাড়া করতে। বাচ্চাদের সরল মন কত চিন্তাহীন হয়৷ বহু যুগ আগে ফেলে আসা সেই শিশুমনকে মলয়বাবু হিংসা করেন মনে মনে৷ যদি আবার ফিরে পাওয়া যেত! শরীর ভাঙে ভাঙুক, শুধু মনটা যদি আবার নাতনির মতো হয়ে যেত, আহা। দুঃখ কষ্ট আর মাথায় ভিড় করে থাকা রাশি রাশি চিন্তার কোনো বালাই থাকত না।


"দিদিভাই, পেট ভরে খেয়ে নিয়েছিস তো? এরপর খেতে তো দেরী হবে অনেক। চ নিচে গিয়ে দাঁড়াই।" দাদাইয়ের হাত ধরে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সে নিচে নেমে আসে। এখন দাদু আর নাতনীর তেমন কোনো কাজ নেই৷ দুজনে এক কোণে বসে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সব। বৌমা ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতেই নারকেল নাড়ুর শিশি গুঁজে দেয় একটা হ্যান্ডব্যাগে৷ রমা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ছেলে বৌমার চোখে মুখে চাপা টেনশন। এত দূরের যাত্রাপথ। তাই এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। ছেলে এখনো ফোনে, বোঝা যায় অনেকক্ষণ লাইন ধরে আছে৷ মাঝেমাঝেই হতাশ হয়ে বলছে, "সময়ের কোনো দাম নেই এদের৷ কুড়ি পঁচিশ মিনিট ধরে শুধু হোল্ডেই রেখে দিয়েছে। এদিকে ড্রাইভার আসার সময় হয়ে গেল।"


ড্রাইভার সাহেবের লম্বা আয়ু। কলিং বেল বেজে উঠল সশব্দে। মলয়বাবু উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই লম্বা চওড়া চেহারার এক ভদ্রলোক বললেন, "গাড়ি রেডি।" পাড়ায় নতুন মনে হয়৷ আগে দেখেননি একে। মালপত্র তুলতে শুরু করবেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন ড্রাইভার। ছেলে কিছু একটা বলল ঘরের ভেতর থেকে, শোনা গেল না স্পষ্ট। বৌমা এসে সবুজ সংকেত দিল গাড়িতে লাগেজ তোলার৷ ছেলে এয়ারপোর্টের ফোন লাইন পেয়েছে অবশেষে, কথা বলছে ওদের সঙ্গে৷


গাড়ির ডিকি খুলে ভারী ভারী সব ব্যাগ ঢোকাতে শুরু করলেন ভদ্রলোক। বড় ব্যাগগুলো আগে রাখছেন, মাঝারিগুলো তারপর যাবে, শেষে ছোটরা সুযোগ পাবে। চোস্ত হাত। বলশালী চেহারা হলেও বড় ব্যাগগুলো চাগাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাঁকে। গরমে ঘেমেনেয়ে গেছেন।


দিয়াশার নরম দুই হাত দুদিক থেকে শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মলয়বাবু আর তাঁর স্ত্রী। মুঠো আলগা করছেন না দুজনেই। প্রতিবেশীরা সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করছে, "কী, নাতনিরা ফিরে যাচ্ছে আজ? আবার কবে আসবে?" কোনো উত্তর দিচ্ছেন না মলয়বাবু। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছেন। চেয়ে আছেন গাড়িটার দিকে। দিয়াশার হাতের স্পর্শ টের পাচ্ছেন। সে এবার ছাড়াতে চাইছে হাতটা। ঠাম্মি ছেড়ে দিলেও মলয়বাবু ছাড়তে পারছেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই মুহূর্ত অবশেষে উপস্থিত।


সব লাগেজই গাড়ির পেছনে ভরে হাত ঝাড়লেন ড্রাইভার। মাঝের একটা সিটও ভাঁজ করে নিয়েছেন। নয়ত এত মাল ধরানো যেত না। দাদাই আর ঠাম্মিকে হামি দিয়ে দিয়াশা দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ে সামনের সিটে। অভ্যেস মতো সিটবেল্ট পরবে বলে টানাটানি করতে থাকে সেটাকে নিয়ে। মলয়বাবু পকেট থেকে রুমালটা বের করে হাতের মুঠোয় রাখলেন। স্ত্রীয়ের সুবিধা আছে, শাড়ির আঁচলটা কাজ দেয় এই সময়ে। গাড়ির দরজা ধরে ওরা দাঁড়িয়ে ছেলে বৌমার অপেক্ষায়। ওরা এলেই গাড়ি ছাড়বে। পাসপোর্ট ভিসা সব গুছিয়ে নিচ্ছে হয়ত। দিয়াশার আর তর সইছে না। সে জোরে হাঁক দেয়, "মাম্মা, হারি আপ।" বৌমা বেরিয়ে আসে হন্তদন্ত হয়ে। তার মুখ দেখে বোঝা যায় যে সে বিরক্ত, আর কিছুটা চিন্তিতও। রমা জিজ্ঞেস করলেন, "সব ঘরগুলো একবার দেখে নিয়েছ তো বৌমা? কিছু ভুলে যাওনি তো তাড়াহুড়োয়? পড়ে থাকলে আমি রেখে দেব যত্ন করে, চিন্তা কোরো না।"


বৌমা উদ্বেগ মাখানো গলায় বলে, "সে সব ঠিক আছে মা। কিন্তু আপনার ছেলে এখনো এয়ারলাইনের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। আমি ডাকতে গেলাম, বিরক্ত হয়ে বলল বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে। আবার লেট ফেট হবে কিনা কে জানে। আসার সময়েও এক ঘন্টা ঝুলিয়েছিল।"


মলয়বাবু চোখ কুঁচকে তাকান দরজার দিকে। চেতন আর অবচেতন মনের লড়াই চলছে তাঁর ভেতরে। মনে ক্ষীণ একটা আশা৷ কিন্তু তা বলা যাবে না এদের। পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জুতো গলিয়ে নিয়ে ছেলে বেরোচ্ছে মনে হয়৷ ঠিকই ধরেছেন। ছেলে বিব্রত মুখে গাড়ির সামনে এসে বলে, "এবার থেকে সিরিয়াসলি এই রুটে আসা বন্ধ করে দেব। মিনিমাম একটা দায়িত্ব নেই এদের যে আগে থেকে জানাবে। এখন কীভাবে সব ম্যানেজ করি? অফিসেই বা কী বলি? মাথা কাজ করছে না আর।"


মলয়বাবু এগিয়ে যান। ছেলের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন, "মাথা ঠাণ্ডা কর। কী হয়েছে বল না আমায়।"


ছেলে এক নিশ্বাসে বলে, "বাবা, এতক্ষণে ওরা আমায় জানালো পুরো কেসটা। কিছু টেকনিকাল ফল্টের জন্য প্রথমে ভেবেছিল দু চার ঘন্টা লেট করবে। শেষে নাকি সারাতে পারেনি, বুঝেছে অনেকটা সময় লাগবে। তাই আগামীকাল সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশে ফ্লাইট রিশিডিউল করেছে। কী বলি এখন অফিসে? স্কুলটাও কামাই হবে। সব ঘেঁটে গেল। দিয়াশা নেমে আয় গাড়ি থেকে। দাদা, আপনাকেও..."


ছেলে এগিয়ে যায় ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে৷ মলয়বাবু রুমালটা পকেটে ঢোকান। রমা দেবী আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন। অল্প কটা ভাত বেঁচে ছিল, তাতে আজ দুপুরে দুটো লোকের হয়ে যেত আরামসে। তাঁর মনে পড়ল নাতনীর একটা অপূর্ণ সাধ রয়ে গেছে। আজ লম্বা জার্নি বলে বৌমার বারণ শুনে আর জোর করেননি। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে সেই সুযোগ এসেছে আবার। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, "বুড়ো, চট করে বাজারে গিয়ে দেখো তো একটু পাঁঠা পাওয়া যায় কিনা। নাতনিটা খুব বায়না করছিল আর একবার খাবে বলে। আমি যোগাড়যন্ত্র করছি। দেরি করবে না কিন্তু!"


দিয়াশা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামতেই ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেলেন মলয়বাবু৷ সে ঘাবড়ে গিয়ে তাকাতে ওর দিকে চোখ টিপে বললেন,


"দিদিভাই, হাঁসগুলোকে আর একবার গুডবাই বলতে হবে তো!"


দিয়াশার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আনন্দে। কে বলেছে ভালো সময় তাড়াতাড়ি চলে যায়৷ চাইলে একটা দিনকেও তো এক মাসের চেহারা দেওয়া যায়। মলয়বাবু কিছু বলতে দেন না নাতনিকে। নিজেই বলে চলেন, "হংসের মাঠ হয়ে চ দুজনে মিলে একবার ডাব খেয়ে আসি বাজার থেকে। যা গরম পড়েছে আজ! তারপর মাংস কিনে বাড়িতে দিয়ে আবার ঢেঁকির মাঠে যাব৷ প্রাণ ভরে দোলনা আর ঢেঁকি চড়ে নিস। হয়ে গেলে একবার তারা মায়ের মন্দিরে যাব মাথা ঠেকাতে। তারপর তোতে আমাতে একবার স্টেশন ঘুরে আসব চল। তারপর সেখান থেকে..."



©2025 by Sambandh. Proudly created with Wix.com

While contacting us, you provide us with your personal information like email address and phone number which will be stored by the organization. Other than the above stated information, we also store your feedback to help address your questions and serve you better. Additionally, we may also reach out to you to get, and poll your opinions through surveys or questionnaires via email, telephone, or text messages. If you wish not to be contacted, you can inform us at sambandhsweden@gmail.com and we will respect and abide by your decision. 

Our organization website is hosted on the Wix.com platform. Wix.com provides us with the online platform that allows us to sell the tickets. Your data may be stored through Wix.com’s data storage, databases and the general Wix.com applications. They store your data on secure servers behind a firewall. All direct payment gateways offered by Wix.com and used by Sambandh adhere to the standards set by PCI-DSS as managed by the PCI Security Standards Council, which is a joint effort of brands like Visa, MasterCard, American Express and Discover.

bottom of page